ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া''

সন্ধ্যার আলো আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ছে। শহরের রাস্তাগুলোয় মানুষের ভিড়—একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলছে যেন। কেউ যাচ্ছে অফিস থেকে বাসায়, কেউ কাজ খুঁজতে, কেউবা স্রেফ হেঁটে বেড়াচ্ছে। এ ভিড়ে একজন মানুষ আছেন, নাম তার রায়হান। বয়স ২৮, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন তিন বছর হলো, কিন্তু আজও একটি স্থায়ী চাকরি জোটেনি। রায়হান এই জনসমুদ্রে হাঁটছেন, মুখে একরাশ হতাশা। চোখে সানগ্লাস, মাথায় ক্যাপ—লোকটার মনে প্রশ্ন, "এই সমাজে আমার জন্য কোনো জায়গা আছে তো?" এ শহরে হাজারো মানুষ ঘুরছে, কিন্তু সবাই কি নিজের জীবনের লক্ষ্য জানে? সমাজ ও দেশের বাস্তবতা রায়হান নিজের জীবন নিয়ে ভাবে—“আমি যদি একটা চাকরি না পাই, পরিবারকে কীভাবে সামলাবো? বাবার বয়স হয়েছে, মা অসুস্থ, ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ—সব আমার ঘাড়ে।” দেশে হাজার হাজার মেধাবী তরুণ আজ বেকার। ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও সুযোগের অভাব, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতির কারণে তারা প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছে। শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের সার্টিফিকেট দিচ্ছে, কিন্তু জীবনের প্রস্তুতি নয়। সমাজের একাংশ বিলাসিতায় মত্ত, অন্যাংশ দিন কাটায় অন্নের চিন্তায়। এই বৈষম্য আমাদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি। আমরা সবাই যদি শুধু নিজেরটা ভাবি, তাহলে সমাজ একদিন থেমে যাবে। পরিবারের জন্য করণীয় রায়হান ভাবেন, "পরিবার মানে শুধু রক্তের সম্পর্ক নয়, মানে হলো দায়িত্ব। আমি এখন যেটুকু আছি, তা এই পরিবারের কারণেই। এখন আমার পালা তাদের জন্য কিছু করার।” পরিবার শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা নয়, মানসিক সাহসও চায়। সন্তান যখন হতাশ, বাবা-মায়ের উচিত তাকে ভালোবাসা ও উৎসাহ দিয়ে সামনের পথ দেখানো। আবার, সন্তানের উচিত নিজেদের অবস্থান থেকে কিছু করা—যদিও সামান্য হয়। কখন করবো? এই প্রশ্নটাই গুরুত্বপূর্ণ—"কখন করবো?" উত্তর সহজ—এখনই। ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে না। সময় চলে যায়, আর ফিরে আসে না। আজ যে বেকার, সে যদি আজ চেষ্টা না করে, আগামীকাল সে আরও পিছিয়ে যাবে। আজ যে সমাজ সমস্যায় আছে, আমরা যদি এখন সচেতন না হই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও দুর্ভোগে পড়বে। আত্মজাগরণের মুহূর্ত রায়হান হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে একটা ছোট ছেলে দেখতে পেল—হাতে কিছু ফুল, বিক্রি করছে। বয়স ১০ হবে। রায়হান কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, —“স্কুলে যাও?” ছেলেটা হেসে বললো, “না ভাইয়া, মা অসুস্থ, কাজ না করলে খাব কী?” এই ছোট্ট মুখ রায়হানের ভিতরের মানুষটাকে নাড়িয়ে দিল। সে ভাবলো, “আমি তো অন্তত পড়াশোনা করতে পেরেছি। চেষ্টা করলে হয়তো কিছু একটা শুরু করতে পারি। হয়তো একদিন এমন অনেক ছেলেকে স্কুলে ফেরাতে পারবো।” বদলে যাওয়া শুরু রায়হান বাড়ি ফিরে ঠিক করলো—ফ্রিল্যান্সিং শেখা শুরু করবে। ধীরে ধীরে সে ডিজাইন শিখে কাজ পেতে লাগলো। কয়েক মাস পর নিজেই ছোট একটা টিম গড়ে তুললো। এরপর আরও কয়েকজন বেকার বন্ধুদের নিয়ে শুরু করলো ‘টিম হোপ’—যারা ফ্রিল্যান্সিং শেখে ও অন্যদের শেখায়। এক বছর পর রায়হান এমন ৫০ জন তরুণ-তরুণীর জীবনে নতুন আলো এনেছে। সেই ছেলেটাকেও স্কুলে ভর্তি করেছে, যার নাম ছিল রাহিম। শেষ কথা ছবির সেই ভিড়ের মাঝে রায়হান ছিল একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ। কিন্তু সঠিক সময়ের সিদ্ধান্ত, পরিবার-সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ, আর নিজের প্রতি বিশ্বাস তাকে আলাদা করে দিয়েছে। আজ আমরা যারা ভিড়ে হাঁটছি, তাদের ভাবতে হবে—"আমি কী করতে পারি?" সমাজ, দেশ, পরিবার—সবকিছু ঠিক হবে তখনই, যখন প্রতিটি মানুষ নিজেকে জাগিয়ে তুলবে। স্মরণীয় কিছু কথা: "বেকার থাকাটা অপরাধ নয়, চেষ্টা না করাটাই অপরাধ।" "সমাজ বদলায় একজন মানুষ থেকেই, শুরুর প্রয়োজন শুধু সাহস।" "ভবিষ্যৎ গড়ার সেরা সময় হচ্ছে এই মুহূর্ত।" "পরিবার শুধু আশ্রয় নয়, অনুপ্রেরণার উৎস।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ