আমার কি ভূল ছিল ?

পর্ব ১: শুরু যেখান থেকে সুরমা নগর। নামটা যেমন মায়াময়, শহরটাও ঠিক তেমনই। রেলস্টেশন, পুরাতন লাইব্রেরি আর পুকুর ঘেরা ছোট্ট শহরে জীবনের গল্পগুলো বড্ড বেশি রঙিন আর অশ্রুভেজা। রাফি – এই শহরের অচেনা এক নায়ক। বাবার ক্ষুদ্র দোকান, ঝুপড়ি ঘর আর একটা স্বপ্ন ছিল ওর সবকিছু। সকালে কলেজ, বিকেলে দোকানে সাহায্য আর রাতে নিজের চায়ের কাপে স্বপ্নের চুমুক – এই ছিল ওর দিনযাপন। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল জসিম আর রনি। জসিম ছিল রাফির জীবনের প্রথম শিক্ষক। পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা তার কাছ থেকেই এসেছে। সে নিজে মেধাবী হওয়ায় রাফিকেও শিখিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। রাফি যখন হতাশ হয়ে পড়তো, তখন জসিম তার পাশে দাঁড়িয়ে বলতো, “কষ্ট সইলে একদিন সফলতা আসবেই।” রফির জীবনে জসিমের উপস্থিতি ছিল বড়ো আশীর্বাদ। রনি ছিল রাফির বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে মজা করার ছেলে। সে কখনোই সিরিয়াস থাকতো না। তবে রাফির প্রতিটি কঠিন সময়ে হাস্যরসের মধ্যে থেকে তাকে উৎসাহিত করতো। রনি প্রায়ই বলতো, “যতই কঠিন হোক, খোলামেলা হাসি, তোমার দিন বদলাবে।” একদিন কলেজের করিডোরে প্রথম দেখা আয়শার সঙ্গে। সাদা-সবুজ ড্রেস, চোখে কাজল, হাতে ব্র্যান্ডেড ব্যাগ। চোখে পড়ার মতো সৌন্দর্য, কিন্তু তার থেকেও বেশি ছিল ওর আত্মবিশ্বাস। রাফি: (গভীর কষ্ট নিয়ে) “আমার স্বপ্নগুলো কখনো তোমার চোখে আঁকা হয়নি, আয়শা। তুমি জানো না, কতবার তোমার অপেক্ষায় বসে থেকেছি। একদিন হয়তো বুঝবে, ভালোবাসা কখনো হারিয়ে যায় না, শুধু ভুল হয়ে যায়।” কিছুদিনের মধ্যেই তাদের কথা বলা শুরু হয়। আয়শার বন্ধুমহলের বাইরে রাফিই ছিল একমাত্র ছেলেটা, যার সঙ্গে সে মন খুলে হাসত, কথা বলত। আয়শার সেরা দুই বন্ধু ছিল সুমনা আর তানিয়া। সুমনা ছিল ঠাণ্ডা মাথার, ধীরে চিন্তা করা মেয়ে। একসময় সুমনা আয়শাকে বুঝিয়েছিল যে, “রাফি ভালো ছেলে, তবে তাকে ছাড়তে পারলে তুমি জীবন সহজে পার করতে পারবে না।” সুমনার এই কথাগুলো নীরবভাবে আয়শাকে ভাবতে বাধ্য করেছিল। আর তানিয়া ছিল পরিপূর্ণ উচ্ছ্বল। সে প্রায়ই আয়শাকে বলতো, “এত ভালো, এত রোমান্টিক! কিন্তু তুমি জানো না, একদিন রাফি নিজেই সফল হবে, তখন কী হবে?” কিন্তু ভালোবাসার গল্পগুলো সহজ হয় না কখনোই। ধনী পরিবারের মেয়ে আয়শা, যার প্রতিদিনকার বিলাসিতা রাফির স্বপ্নেরও বাইরে। তবুও আয়শা ওকে ভালোবাসে, অন্তত তাই বলে। আয়শা: (কাঁদতে কাঁদতে, রাফির দিকে তাকিয়ে) “রাফি, তুমি জানো না, তোমাকে আমি কত ভালোবাসতাম! কিন্তু কখনো বুঝতে পারলাম না, তোমার ভালোবাসা কি আসলেই আমার জন্য ছিল? আমি কি তোমার মতো কাউকে হারানোর মতো ভুল করেছিলাম?” পর্ব ২: ভাঙনের আগুন আস্তে আস্তে আয়শার ব্যাবহারে পরিবর্তন আসতে থাকে। সে আগের মতো আর সময় দেয় না রাফিকে। ফোনে কথা কমে যায়, দেখা করার অজুহাত বাড়ে। একদিন শহরের এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে আয়শাকে দেখা যায় এক ধনী ছেলের সাথে। রাফির বন্ধুরাই খবর দেয়। বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। ভেবে নিল, নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে। কিন্তু ভুল ছিল না। আয়শা নিজেই একদিন রাফিকে ডেকে বলল, “রাফি, তুমি ভালো, কিন্তু ভালো থাকা তো সবকিছু না। আমাদের পথ আলাদা। তুমি আমাকে আর খুঁজো না।” কথাগুলো ছিল ঠাণ্ডা, স্পষ্ট, এবং নির্মম। রাফি শুধু তাকিয়ে ছিল আয়শার চোখে। কোনো অভিযোগ না করে, কোনো অভিশাপ না দিয়ে চুপচাপ চলে গিয়েছিল সে। রাফি: (অশ্রুপূর্ন চোখে) “তুমি চলে গেলে, কিন্তু আমি তো তোমার পেছনে আরো অনেক দিন হাঁটব। আমার জীবনটাকে তোমার চোখে একটুখানি সম্মান দেওয়ার সুযোগও তুমি আমাকে দিলে না। আমি কি সত্যিই এত অক্ষম ছিলাম?” সেই রাতটাতে ঘুম আসেনি তার। চোখের নিচে কালি, মনে অন্ধকার। কিন্তু সে ভাঙেনি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল – “আমি নিজেকে প্রমাণ করব, আমি হার মানব না।” পর্ব ৩: নতুন সূচনা রাফি ঢাকায় চলে যায়। ছোট একটা কোম্পানিতে চাকরি নেয়। দিনে কাজ, রাতে পড়াশোনা। টানা ৫ বছর পরিশ্রমের পর নিজেই একটা স্টার্টআপ খোলে। প্রযুক্তিনির্ভর সেই কোম্পানি ধীরে ধীরে সফল হয়। ব্যবসায়িক সম্মেলনে তার পরিচয় হয় অনেক বড় বড় উদ্যোক্তার সাথে। একসময় তার কোম্পানি দেশের অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মিডিয়াতে তার সাক্ষাৎকার, পত্রিকায় হেডলাইন – “গরিবের ঘরে জন্ম, আজ কোটি টাকার মালিক – রাফি”। কিন্তু রাফির মন তখনো একা। সে অনেক কিছু পেয়েছে, কিন্তু একটুখানি ভালোবাসা যেনো আজও অপূর্ণ। পর্ব ৪: ফিরে দেখা একদিন একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে সে ফিরে আসে সুরমা নগরে। কলেজের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা, পুরনো স্মৃতি ঘেরা শহরটা আজ নতুন চোখে দেখছিল সে। সেই সময় হঠাৎ দেখা হয় আয়শার সঙ্গে। সে এখন বিবাহবিচ্ছিন্না, জীবন তাকে বড্ড কঠিনভাবে শিখিয়েছে টাকার দম্ভে ভালোবাসা কেনা যায় না। আয়শা: (কষ্টে) “তুমি তো জানো, টাকা আর ধনী হওয়ার পেছনে আমি কখনোই ধাবিত হতে চাইনি। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, অন্যরা কীভাবে দেখতে পায়, আমি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি।” আয়শা রাফির সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখে অনুশোচনা, কণ্ঠে আফসোস, “রাফি, আমি ভুল করেছিলাম। তোমায় ভুলে যাওয়া জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।” রাফি: (স্মিত হাসি দিয়ে) “আর এখন, যখন তুমি ফিরে আসলে, আমি জানি... আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু আমি তোমার জন্য নয়, নিজের জন্য।” পর্ব ৫: নতুন গল্প মাহিরা – একজন সাধারণ মেয়ে, তবে হৃদয়ভরা ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং সম্মান দিয়ে গড়া। রাফির সঙ্গে পরিচয় হয় এক সমাজসেবামূলক প্রজেক্টে। প্রথমেই সে মুগ্ধ হয় মেয়েটির মানবিকতায়। ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কোনো বাহুল্য নেই, কোনো অহংকার নেই—আছে শুধু ভালোবাসা, আস্থা। রাফি এবার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়: মাহিরাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করা। বিয়ের দিন আয়শাও ছিল অতিথিদের মাঝে। দূর থেকে দেখে চোখে জল আসে তার। অথচ সে একসময় রাফির হাত ধরেছিল, আজ তাকিয়ে দেখতে হয় দূর থেকে। রাফি: (আয়শার চোখে চোখ রেখে, শান্তভাবে) “আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—যত কিছুই অর্জন করো না কেন, যদি তোমার কাছের মানুষ পাশে না থাকে, তাহলে সেই অর্জন একা বাঁচে না।” আয়শা: (নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে) “তোমার ভালোবাসা আর আমার অজ্ঞতা একে অপরকে ফেলে দিয়েছে। তবে আজ আমি জানি, যে, কিছু হারানো জীবনকে আবার নতুন করে ফিরে আসে।” শেষ কথা ভালোবাসা কখনো ফেলে দেওয়া বস্তু নয়। সেটা যত্ন নিতে হয়, বিশ্বাস রাখতে হয়। কিছু ভুল সিদ্ধান্ত আর কিছু ভুল সময় হয়তো আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়, কিন্তু যখন সত্যি ভালোবাসা আসে, তখন তা যেন সবটুকু অন্ধকার দূর করে এবং মনে এক নতুন রৌদ্র এনে দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ